কালোজিরা (Black Cumin/Nigella) হচ্ছে আমাদের সকলেরই খুব পরিচিত একটি মসলা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nigella Sativa Linn । প্রাচীনকাল হতে মানুষ কালোজিরার ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে এটি আয়ুর্বেদীয়, ইউনানী ও কবিরাজের চিকিৎসাতে ব্যবহার করা হয়।
দৈনন্দিন জীবনে আমাদের কোন না কোন রোগব্যাধি লেগেই থাকে। ছোট খাটো এই সব রোগব্যাধি মোকাবেলা করতে সাহায্য করে প্রাকৃতিক সব খাবার। তাই কালোজিরা হলো সাধারণ কিছু রোগের এক মহৌষধ।
কালোজিরা নিয়মিত ও পরিমিত খেলে আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধন থেকে শুরু করে শরীরে কোষ ও কলার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এতে থাকা শতাধিক পুষ্টি ও উপকারি উপাদান স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কালোজিরা মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি পাঁচ ফোড়নের একটি উপাদান। বাঙালির পাঁচ ফোড়ন থেকে শুরু করে নিমকি, সিঙ্গারা ছাড়া আরও নানা রকম খাবারে কালোজিরা ব্যবহার করা হয়। কালোজিরার বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়। এই তেল চুলের যত্নে মানুষ প্রচুর হারে ব্যবহার করছে। এছাড়া কালোজিরার বীজ দিয়ে ভর্তা করে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
কালোজিরা গর্ভাবস্থায় ও দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের খাওয়ানো উচিত নয়। এছাড়া কালোজিরা পরিমাণমত খাওয়া উচিত, তা না হলে এর হিতে বিপরীত হতে পারে। পুরনো কালোজিরার তেল আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
ইসলাম ধর্মে কালোজিরার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে, “তোমরা কালোজিরা ব্যবহার করবে, কেননা এতে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সর্ব রোগের মুক্তি রয়েছে “। কালোজিরা রোগ নিরাময়ের এক মহৌষধ। যা প্রাচীনকাল হতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়া গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে কালোজিরা একটি সুপার ফুড।
কালোজিরার উপকারিতা
কালোজিরা খাওয়ার অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। এতে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব পুষ্টির উপাদান রয়েছে। কালোজিরার গুণ ও উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এজন্যই কালোজিরাকে সকল রোগের মহৌষধ বলা হয়। চলুন, তাহলে কালোজিরার উপকারিতা সম্পর্কে জেনে যাক –
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে
নিয়মিত কালোজিরা খেলে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। এটি মস্তিষ্কের নার্ভগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। দৈনিক ১ চামচ করে কালোজিরা খেলে স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
বাড়ন্ত ও শিশুরা নিয়মিত মধুর সাথে কালোজিরা খেলে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ বৃদ্ধি পায়। তারা অন্য শিশুদের তুলনায় অধিক প্রতিভার অধিকারী হয়। মস্তিষ্কের প্রকরতা বাড়াতে চাইলে নিয়মিত মধু ও কালোজিরা খেয়ে দেখুন। এটি মেধা বিকাশের জন্য দ্বিগুণ হারে কাজ করে।
মাথা ব্যথা কমাতে
মাথা ব্যথা হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই সমস্যায় কালোজিরার তেল কাজে দেবে। যদি মাঝে মধ্যে মাথা ব্যথার সমস্যা হয়, তাহলে নিয়মিত কালোজিরা খাওয়ার পাশাপাশি এর তেল মাথায় ব্যবহার করুন। কপালের দুই পাশ এবং কানের পাশে দিনে ৩-৪ বার কালোজিরার তেল মালিশ করুন।
কালোজিরা ঠান্ডাজনিত মাথাব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও একটি সুতির কাপড়ের টুকরোয় খানিকটা কালোজিরা নিয়ে পুঁটলি তৈরি করুন। এই পুঁটলি নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টানতে থাকুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা সেরে যাবে।
চুল পড়া কমাতে
মাথার চুল পড়ার প্রধান কারণ হলো চুলের গোড়ায় খুশকি, পুষ্টির অভাব, দূষিত আবহাওয়া ও পরিবেশ। নিয়মিত কালোজিরা খেলে মাথার চুলের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়। কারণ কালোজিরাতে প্রচুর বিটা-ক্যারোটিন থাকে, যা চুলের বৃদ্ধির হারকে দ্রুত করে।
বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি চুল পড়ার সমস্যা কমিয়ে দিতে সক্ষম। তাই চুল পড়া কমাতে প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে কালোজিরা খাওয়া উচিত। আরও ভাল ফল পেতে চুলের গোড়ায় এর তেল মালিশ করতে হবে। কারণ কালোজিরা চুলপড়া রোধ ও নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
লিভার ভাল রাখতে
লিভারে জমে থাকা জীবাণু দূর করার জন্য কালোজিরা এক মহৌষধ। নিয়মিত কালোজিরা খেলে লিভারের প্রদাহ কমে। তাছাড়া এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট লিভার পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কালোজিরা লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আফলাটক্সিন নামক বিষ ধ্বংস করে।
সর্দি, কাশি দূর করতে
কালোজিরা সর্দি, কাশি, কফ কমাতে উপকারি বন্ধু হিসেবে কাজ করে। কালোজিরা সর্দি, কাশি হলে ৩-৪ দিনে এ সমস্যাকে কমিয়ে স্বস্তি দিবে। এজন্য কালোজিরা ভেজে ১ চামচ মধুর সঙ্গে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।সিজনারি সর্দি, কাশি দূর করার জন্য কালোজিরার গুঁড়া ও তুলসি পাতার চা বানিয়ে খেলেও উপকার মিলে।
তাছাড়া সর্দি বসে গেলে কালোজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিন। একই সঙ্গে পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে কালোজিরা বেঁধে শ্বাস নিতে থাকুন, শ্লেষ্মা তরল হয়ে ঝরে পড়বে। আরো দ্রুত ফল পেতে বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশ করুন।
কালোজিরা খেলে সর্দি কাশি দূর হবে কোন প্রকার ঔষধের সাহায্য ছাড়া। তাছাড়া সর্দি থেকে মাথা ব্যথা হলে এটা ভালো করবে কালোজিরা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কালোজিরা খুবই উপকারি। ডায়াবেটিস সমস্যায় শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর জন্য কালোজিরা বেশ কার্যকর।
এর পাশাপাশি এটি ইনসুলিন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১ চিমটি পরিমাণ কালোজিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে সকালে খালি পেটে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উপায় হলো কালোজিরা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে
কালোজিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। কালোজিরার তেল ব্যবহার ও সেবন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং রোগমুক্ত রাখে। নিয়মিত কালোজিরা খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পতঙ্গ সতেজ থাকে।
এতে করে যেকোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে। কালোজিরায় রয়েছে শরীরের রোগ জীবাণু ধ্বংসকারী উপাদান। যা শরীরকে ঘা, ফোঁড়া ও সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা করে।
হজমশক্তি বাড়াতে
হজমশক্তি বাড়াতে কালোজিরা বেশ কার্যকরী। হজম সমস্যায় প্রতিদিন ১-২ চা চামচ কালোজিরা বেটে পানির সঙ্গে খেলে হজমশক্তি বেড়ে যাবে। এছাড়া পেট ফাঁপা ভাব ও দূর হবে।
কফ ও হাঁপানিতে
বুকে কফ জমে গেলে শ্বাস কষ্ট, অন্যদিকে হাঁপানি সমস্যায় কালোজিরা তেল কার্যকরী। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়লে কফ ও হাঁপানি দ্রুত আরোগ্য মেলে। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মধু ও কালোজিরা একত্রে খেলে উপকার পাওয়া যায়। কালোজিরা হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার উপশম করবে।
খোস পাঁচড়া দূর করতে
শরীরে রক্ত নালীতে খুব বেশি পরিমাণ জীবাণু থেকে বিভিন্ন খোস পাঁচড়া হয়। এসব খোস পাঁচড়া দূর করার জন্য কালোজিরার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রক্ত পরিস্কারক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া কালোজিরায় রয়েছে আরও এনজাইম বর্ধকগুণ। যার ফলে মানুষের রুচির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
শক্তি বাড়াতে
যারা শারীরিক ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রাকৃতিক উপায় খুঁজছেন, তাদের জন্য বেশ প্রচলিত একটি প্রাকৃতিক ঘরোয়া টোটকা হলো মধু ও কালোজিরা একত্রে খাওয়া। এটি শরীরের শক্তি বাড়িয়ে শরীরকে মজবুত এবং অলসতা হ্রাস করবে।
অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি কমাতে
চায়ের সাথে কালোজিরা মিশিয়ে পান করলে তা বাড়তি মেদ ঝরে যেতে সাহায্য করে। এছাড়া প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ চামচ মধুর সাথে অর্ধেক চামচ কালোজিরা খাওয়ার অভ্যাস করলে শরীরের অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি কমে যাবে।
বুকের দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে
কালোজিরা যেসব মায়েদের বুকে পর্যাপ্ত দুধ নেই তাদের মহৌষধ। প্রতিদিন রাতে শোবার আগে ৫ থেকে ১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সঙ্গে খেলে অল্প দিনে দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে। এছাড়া এ সমস্যা সমাধানে কালোজিরার ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
দাঁত ব্যথা কমাতে
দাঁত ব্যথা হলে কুসুম গরম পানিতে কালোজিরা দিয়ে কুলকুচা করলে ব্যথা কমে। দাঁতের মাড়ি ফোলা ও রক্ত পড়া বন্ধ করার পাশাপাশি মূখের দুর্গন্ধ দূর করবে। জিহ্বা, তালু, দাঁতের মাড়ির জীবাণু ধ্বংস হয়ে স্বস্তি এনে দিবে।
ফোঁড়া সারাতে
কালোজিরা ব্যথাযুক্ত ফোঁড়া সারাতে সাহায্য করে। তিলের তেলের সাথে কালোজিরা বাটা বা কালোজিরার তেল মিশিয়ে ফোঁড়াতে লাগালে, ব্যথা উপশম হয় এবং ফোঁড়া সেরে যায়।
যৌন ক্ষমতা বাড়াতে
কালোজিরা নারী ও পুুরুষ উভয়ের যৌন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে পুরুষদের জন্য এটি খুবই উপকারি।
বাতের ব্যথা কমাতে
বাতের ব্যথা দূর করতে কালোজিরার তেল ব্যথার স্থানে মালিশ করতে হবে। এতে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। তবে পুরনো কালোজিরার তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
পেটের সমস্যা দূর করতে
অন্ত্রের জীবাণু ধ্বংস করে শরীরে জমে থাকা গ্যাসকে দূর করতে কালোজিরার বিকল্প নেই। তাছাড়া আমাশয় রোগের চিকিৎসা করতে কালোজিরার ব্যবহার খুব পুরনো।
হার্টের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তিতে
কালোজিরা প্রতিদিন পরিমাণমত খাওয়ার অভ্যাস করলে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ত্বক উজ্জ্বল করতে
মধু ও কালোজিরার পেস্ট বানিয়ে ত্বকে লাগিয়ে আধা ঘন্টা বা এক ঘন্টা রেখে ধুয়ে ফেললে ত্বক উজ্জ্বল হয়। নিয়মিত লাগালে ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর করতে সাহায্য করবে।
কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম
কালোজিরা খাওয়ার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। এটি বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। কালোজিরাকে রান্নায় মসলা হিসেবেও খাওয়া যায়। তবে এটি ভেজে বয়ামে সংরক্ষণ করে বেটে ভর্তা বা মধুর সঙ্গে খাওয়া যায়। তবে কালিজিরা গুঁড়া করে মধুর সাথে মিশিয়ে সকালবেলা খালি পেটে খাবেন। এতে সবচেয়ে বেশি ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে।